১০ কোটি ডলার বা এর বেশি বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা বিশ্বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। এ হার কোনো কোনো শহরে আগের বছরের তুলনায় শতভাগ ছাড়িয়ে গেছে বলে গবেষণা সংস্থা হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বড় শহর দুবাই, আবুধাবি ও রিয়াদে অতিধনীর সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে সাম্প্রতিক প্রবণতা বজায় থাকলে ২০৪০ সাল নাগাদ সেন্টি-মিলিয়নেয়ার বাড়বে ১৫০ শতাংশ।
লন্ডনভিত্তিক হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের ‘সেন্টি-মিলিয়নেয়ার রিপোর্ট ২০২৪’ অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বে ২৯ হাজার ৩৫০ ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি ডলার বা এর বেশি অর্থ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অতিধনীর আবাসস্থল হিসেবে তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তবে তুলনামূলকভাবে সেন্টি-মিলিয়নেয়ার বৃদ্ধিতে এগিয়ে রয়েছে উপসাগরীয় শহরগুলো, যা আগামী দেড় দশকে আরো বাড়বে।
ধনীদের এ ক্লাব গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী ৫৪ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে অঞ্চলভেদে বৃদ্ধির হারে তারতম্য রয়েছে, কোনো কোনো দেশে অতিসমৃদ্ধির বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে সেন্টি-মিলিয়নেয়ারের বড়সড় উল্লম্ফন ঘটেছে। যেখানে দেশ দুটি উল্লেখযোগ্যভাবে ইউরোপীয় প্রতিপক্ষদের ছাড়িয়ে গেছে।
চীনে অতিধনীর বৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে নাটকীয়, গত ১০ বছরে দেশটিতে সেন্টি-মিলিয়নেয়ার জনসংখ্যা বেড়েছে ১০৮ শতাংশ, যা যুক্তরাষ্ট্রের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সকেও ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিনদের মধ্যে একই সময়ে অতিধনী বেড়েছে ৮১ শতাংশ। সে তুলনায় ইউরোপে সম্পদের পুঞ্জীভবন অনেকটাই ম্রিয়মাণ। গত এক দশকে এ অঞ্চলে সেন্টি-মিলিয়নেয়ার বেড়েছে ২৬ শতাংশ।
ইউরোপ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো প্রধান অর্থনীতিগুলোর ধীরগতিকে দায়ী করলেন হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের সিইও ড. জুয়ের্গ স্টেফেন। আবার এ অঞ্চলের কিছু দেশে সেন্টি-মিলিয়নেয়ার বৃদ্ধির হার যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি। তিনি বলেন, ‘মোনাকো, মাল্টা, মন্টিনিগ্রো ও পোল্যান্ডের মতো ছোট ইউরোপীয় বাজার এখনো গতিশীল, এসব দেশে সেন্টি-মিলিয়নেয়ার ৭৫ শতাংশ বা এর বেশি বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আর্থিক সমৃদ্ধির ভূগোল বদলে যাচ্ছে। অভিজাত গোষ্ঠী ক্রমাগত বাড়ছে ও এক দেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজে এর প্রভাব গভীর ও সুদূরপ্রসারী হতে পারে।’
সেন্টি-মিলিয়নেয়ার জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপথে সম্পদ আহরণ ও স্থানান্তরের আকর্ষণীয় চিত্র তুলে ধরে ২০৪০ সালের জন্য দেয়া পূর্বাভাস। সামনে দিনগুলোয় বিভিন্ন দেশের সরকারের দেয়া নীতি সুবিধা অনুসরণ করে ধনীদের মাঝে সম্পদের স্থানান্তর হার বাড়বে। এসব ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের ভূমিকা নিয়েও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক সংস্থা ও দেশ তদন্ত জারি রেখেছে।
আগামী দশকে বেশ কয়েকটি এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের শহর সেন্টি-মিলিয়নেয়ার বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত। এর মধ্যে হ্যাংঝো, শেনজেন, তাইপেই, দুবাই ও আবুধাবি ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দেখতে পারে। উদীয়মান বাজারও এ ধরনের প্রবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত। সৌদি আরবের রিয়াদ ও ভারতের বেঙ্গালুরুতে আগামী দেড় দশকে অতিধনী জনসংখ্যা ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সেন্টি-মিলিয়নেয়ার বসবাস করে এমন ২০ শহরের প্রথম তিনটিই যুক্তরাষ্ট্রে। এগুলোর মধ্যে প্রথম হলো নিউইয়র্ক, যেখানে ৭৪৪ জন অতিধনী বসবাস করেন। এরপর রয়েছে বে এরিয়া (৬৭৫) ও লস অ্যাঞ্জেলস (৪৯৬)। শীর্ষ বিশের বাকি শহর হলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন (৩৭০), চীনের বেইজিং (৩৪৭), সিঙ্গাপুর (৩৩৬), চীনের সাংহাই (৩২২), হংকং (৩২০), যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো (২৯০), ফ্রান্সের প্যারিস (২৮৬), জাপানের টোকিও (২৬৭), যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন (২৫৮), সুইজারল্যান্ডের জেনেভা (২৪৪), ভারতের মুম্বাই (২৪৪), ইউএইর দুবাই (২১২), রাশিয়ার মস্কো (২০৭), অস্ট্রেলিয়ার সিডনি (২০৫), সুইজারল্যান্ডের জুরিখ (২০৫), কানাডার টরন্টো (১৯৫) ও দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল (১৯৫)। এছাড়া আবুধাবি ও রিয়াদের সেন্টি-মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা যথাক্রমে ৬৮ ও ৬৭ জন।
গবেষণা সংস্থা নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ রিসার্চের প্রধান অ্যান্ড্রু অ্যামোয়েলস জানান, মাল্টি-মিলিয়নেয়ারদের ৬০ শতাংশেরও বেশি উদ্যোক্তা ও কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। এসব ব্যবসা তাদের সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, ‘মধ্যবিত্তের ওপর সেন্টি-মিলিয়নেয়ারদের শুরু করা ব্যবসার উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। কারণ তারা নিজেদের দেশে প্রচুর পরিমাণে ভালো বেতনের চাকরি তৈরি করেন।’
অ্যান্ড্রু অ্যামোয়েলস আরো বলেন, ‘এটাও লক্ষণীয় যে ফরচুন ৫০০, এসঅ্যান্ডপি ৫০০, সিএসি ৪০, এফটিএসএ ১০০ ও নিক্কেই ২২৫-এর বেশির ভাগ কোম্পানি এমন ব্যক্তিরা শুরু করেছিলেন, যারা পরবর্তী সময়ে সেন্টি-মিলিয়নেয়ার খেতাব পেয়েছেন।’
সেন্টি-মিলিয়নেয়ারদের এক-তৃতীয়াংশ বিশ্বের ৫০টি প্রধান শহরে বাস করে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়সহ অভিজাত তালিকার মোট ১৫টি মহানগরের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রে। গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থান বজায় রাখার যে ধারাবাহিকতা—এ শহরগুলো আগামী ১০ বছরেও সে ধারা অনুসরণ করবে। সেখানে অতিধনী জনসংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের সিইও ড. জুয়ের্গ স্টেফেন জানান, সামনে সেন্টি-মিলিয়নেয়ার বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে বিদেশে বিনিয়োগ সুবিধা। প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, সেন্টি-মিলিয়নেয়ারদের জন্য শীর্ষ ৫০ শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই বিনিয়োগের বিপরীতে অভিবাসনের সুবিধা দিয়ে থাকে। অর্থাৎ বৈশ্বিক সম্পদের পুঞ্জিভবন ও স্থানান্তরের সঙ্গে দেশগুলোর কৌশলগত অবস্থান ও পরিকল্পনা যুক্ত। (খবরঃ অ্যারাবিয়ান বিজনেস)
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন