উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় চাপের মুখে রয়েছে বৃহৎ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। এ কারণে ব্যবসা কৌশল পরিবর্তন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অনেক কোম্পানি। তেমন একটি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার কয়েক মাস আগেই ব্যবসা পুনরুদ্ধারের নতুন পরিকল্পনার বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে শিগগিরই ইউরোপ থেকে এক-তৃতীয়াংশ কর্মী ছাঁটাই করছে ব্রিটিশ ভোক্তাপণ্য সংস্থাটি। এতে প্রভাবিত হবেন ৩ হাজার ২০০ কর্মী।
গত বছর ইউনিলিভারে সিইও হয়ে আসেন হেইন শুমাখার। আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত সময়ে এ নিয়োগ শুরুতেই তাকে চাপের মুখে রেখেছিল। ধারাবাহিক নিম্নমুখী ব্যবসার পর বাজার হিস্যা পুনরুদ্ধারের দিকে জোর দিয়ে যাচ্ছিলেন কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা।
দায়িত্ব নিয়েই পুনর্গঠন পরিকল্পনার কথা জানান হেইন শুমাখার। এরপর ইউনিলিভারের বিক্রির গ্রাফে কিছু উন্নতিও দেখা যায়। তবে হেইন শুমাখার এখন আরো উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। গত এপ্রিলে জানিয়েছিলেন, তার হাত ধরে কোম্পানির রূপান্তর এখনো ‘প্রাথমিক পর্যায়ে’ রয়েছে।
এর আগে মার্চে বিশ্বব্যাপী খরচ কমানোর ঘোষণা দেয় ইউনিলিভার। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৭ হাজার ৫০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা জানানো হয় তখন। গত শুক্রবারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের শেষ নাগাদ ইউরোপে ইউনিলিভারের অফিসগুলো প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কর্মী হারাবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইউনিলিভারের ১ লাখ ২৮ হাজার কর্মী রয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপে কর্মরত ১০-১১ হাজার কর্মী।
গত শুক্রবার শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে এক ভিডিও কলের সময় ইউনিলিভারের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা কনস্টান্টিনা ট্রিবো জানান, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ইউরোপে কর্মী ছাঁটাই সম্পন্ন হবে। এর নিট সংখ্যা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০-র মধ্যে হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে অফিসভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে এ জনবল কাটছাঁট প্রযোজ্য হবে। কারখানাভিত্তিক কাজ এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।’
নতুন এ সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হবেন এমন কর্মীদের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
কর্মী ছাঁটাই প্রসঙ্গে কনস্টান্টিনা ট্রিবো বলেন, ‘আমরা স্বীকার করি যে এ প্রস্তাব কর্মীদের মধ্যে খুবই উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। আমরা এ পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে সবাইকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমানে আমরা এ বিষয়ে পরামর্শ করছি।’
অবশ্য ছাঁটাই কর্মীদের অবস্থান সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। তবে কর্মীদের উদ্দেশে এক চিঠিতে ইউনিলিভারের ইউরোপীয় ওয়ার্কস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হারম্যান সোগেবার্গ বলেন, ‘ইউরোপের প্রায় সব কার্যালয়ে সমানভাবে কাটছাঁট হবে। তবে বিশেষভাবে প্রভাবিত হবে লন্ডন ও রটারডামের করপোরেট দপ্তরগুলো।’
যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও নেদারল্যান্ডসের রটারডামে ইউনিলিভারের কার্যালয় রয়েছে। ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যে আইনিভাবে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কোম্পানিটি কয়েক দশক ধরে দ্বৈত সদর দপ্তর বজায় রেখেছিল।
হারম্যান সোগেবার্গ জানান, এ পদক্ষেপের মাধ্যমে কয়েক দশকের মধ্যে ইউনিলিভারে সবচেয়ে বড় কর্মী কাটছাঁট হতে যাচ্ছে।
গত মার্চে জানানো হয়, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য নতুন কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে ইউনিলিভার। তখন হেইন শুমাখারের নেতৃত্বে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসক্রিম বিভাগকে আলাদা করে নতুন কোম্পানি গঠন করা হয়। এ গ্রুপের আইসক্রিমের মধ্যে রয়েছে বেন অ্যান্ড জেরি, ম্যাগনাম ও কর্নেটোর মতো ব্র্যান্ড।
ইউনিলিভারের একজন মুখপাত্র বলেন, মার্চে আমরা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য একটি বিস্তৃত প্রোগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলাম। এর লক্ষ্য ছিল সংস্থাকে বাহুল্যহীন ও আরো স্বচ্ছতার মাধ্যমে উৎপাদনে মনোযোগী ও প্রবৃদ্ধির দিকে চালিত করা। সে পরিকল্পনার মধ্যে আইসক্রিম ব্যবসাকে আলাদা করার সিদ্ধান্তও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোম্পানিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে কীভাবে বেশি মুনাফা করা যায়, সে কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইউনিলিভার।
বিনিয়োগ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওবেরন ইনভেস্টমেন্টসের পোর্টফোলিও ম্যানেজার জ্যাক মার্টিন বলেন, ‘একজন শেয়ারহোল্ডারের দৃষ্টিকোণ থেকে কম পারফরমিং ব্যবসার ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।’
সৌন্দর্যপণ্যের ব্র্যান্ড ডাভ, ডিটারজেন্ট পাউডার পার্সিল ও বডি স্প্রে লিনক্সসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের জন্য পরিচিত ইউনিলিভার বিশ্বের বৃহত্তম ভোগ্য পণ্য কোম্পানিগুলোর একটি।
ইউনিলিভারে হেইন শুমাখারের নিয়োগ ও খরচ কমানোর পরিকল্পনার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন মার্কিন বিলিয়নেয়ার নেলসন পেল্টজের। ২০২২ সালে তিনি কোম্পানিটির বড় একটি অংশ কিনে নেন।
এদিকে ছাঁটাইয়ের খবরের প্রভাব খুব একটা পড়েনি ইউনিলিভারের শেয়ারদরে। শুক্রবার লেনদেন বন্ধ হওয়ার আগে লন্ডন ট্রেডিংয়ে ইউনিলিভারের শেয়ারপ্রতি দর দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ৪৪ দশমিক ৩১ পাউন্ড ছিল। চলতি বছর পুনর্গঠন ঘোষণা করার পর থেকে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে।
সূত্র : ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস ও ইউরো নিউজ।
ক্যাটাগরিঃ অর্থনীতি
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন