সম্প্রতি তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সারাদেশের মানুষ। রাজধানীর লাগোয়া বাণিজ্যক নগরী নারায়ণগঞ্জ তার ব্যতিক্রম নয়। ক্রমাগত গাছশূন্য হতে যাওয়া লাখো মানুষের শহর দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
“২০০৫/০৬ সালে আমি স্কুলে পড়তাম। বাবা মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জ থেকে বেবিট্যাক্সিতে চড়ে ঢাকায় আসা যাওয়ার সময় লিংক রোডের দুই পাশে সারি সারি গাছ দেখতাম। উপরে তাকিয়ে গাছের পাতার ফাঁকে সূর্য খুঁজতাম। সাইনবোর্ড থেকে শিবু মার্কেট পর্যন্ত আসা যাওয়ার পথে গায়ে রোদ লেগেছে এমন কোন স্মৃতি নেই আমার। চোখের সামনে এখনও ভাসে দুপাশে সারি সারি গাছ, আর সেই গাছের ছায়াঘেরা রাস্তায় আমরা চলছি। ১৮ বছর পরে একই রাস্তা ধরে ঢাকায় আসা যাওয়া করি। কিন্তু পুরো রাস্তায় ছায়া দেওয়ার মত একটি গাছও এখন আর অবশিষ্ট নেই,”- কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান।
ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশের একটি এলাকাতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। বর্তমানে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। নিজের চোখের সামনে বদলে যাওয়া সড়কের বর্ননা এভাবেই তুলে ধরেন। সে সময়ের এক লেন থেকে বর্তমানের লিংক রোড ছয় লেনে উন্নীত হয়েছে। গত ১৬ বছরে দুই দফা সংস্কার হয়েছে এই সড়ক। সম্প্রসারিত হওয়ার পর সড়কের দুই পাশের গাছগুলো এখন কেবলই স্মৃতি।
সম্প্রতি তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সারাদেশের মানুষ। রাজধানীর লাগোয়া বাণিজ্যক নগরী নারায়ণগঞ্জ তার ব্যতিক্রম নয়। ক্রমাগত গাছশূন্য হতে যাওয়া লাখো মানুষের শহর দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
এরই মাঝে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ৮.১৫ কিলোমিটার সড়কে ১৬ বছর আগের সবুজে ঘেরা পুরোনো ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি সংস্থাগুলো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গাছ কেটে ফেললেও তার বিকল্প হিসেবে কতগুলো গাছ লাগিয়েছে?
জবাবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস টিবিএসকে বলেন, “প্রকল্পের আওতায় এই সড়কের সড়ক বিভাজনে প্রায় ২২ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য পছন্দ করে দিয়েছেন এসব গাছ। আমরা গাছগুলো দেখভাল করছি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। গাছগুলো যেন বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য পানি দেওয়া হয় যাবতীয় যত্ন নেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া আছে।”
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তথ্য অনুযায়ী, ৯০ দশকের শুরুর দিকে বর্তমান এক্সপ্রেসওয়ের আদলে নির্মিত হওয়া ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়। পোস্তগোলা-পাগলা-পঞ্চবটি তথা ঢাকা নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কের বিকল্প হিসেবে ১৯৯৭ সালে এই সড়কটি উদ্বোধন করা হয়। রাস্তার দুই পাশে লাগানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
যৌবনে সড়কে মোটরসাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো সংবাদকর্মী ইমতিয়াজ আহমেদ নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে– “কলেজ জীবন শেষ করে সদ্য মোটরসাইকেল কিনি। সুজুকি ৮০ মডেলের মোটরসাইকেল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে ঘুরতে যেতাম লিংক রোডের জালকুড়ি, ভুইগড়ের দিকে। রাস্তা চালু হবার পরেও মানুষের সমাগম কম ছিল। রাস্তার দুপাশের গাছের কারণে মনে হতো বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ফলদ গাছ, ঔষধি গাছও ছিল।”
“গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কতদিন আড্ডা দিয়েছি। আর এখন তো মরুভূমি। আগে দেখতাম সওজের কর্মকর্তারা গাছের ব্যাপারে অনেক সচেতন ছিলেন। একটা গাছ কাটা পড়লে সাথে সাথে পাঁচটা গাছ লাগিয়ে সেগুলো পরিচর্যা করতেন। এখন আর সেই সচেতনতা দেখা যায় না। ঠিকাদারদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েই কাজ শেষ,” যোগ করেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবির বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর নারায়ণগঞ্জের নেতা তারিক বাবু টিবিএসকে বলেন, “দুপাশের বড় বড় গাছগুলো ছাতার মত ঢেকে রাখে সড়ককে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য ছিল সেসময়। কিন্তু ২০০৯ সালে একলেন থেকে ডাবল লেন সড়ক নির্মাণের জন্য সড়কের দুইপাশের গাছ কাটা হয়। ডাবল লেন নির্মাণের পরে ফের গাছ লাগানো হলেও সেগুলো প্রথমবারের মত ছিল না। অল্প কিছু গাছ ছিল পুরো সড়কে। আগের সেই সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনতে পারেনি সড়ক বিভাগ।”
“এরপর ২০২১ সালে দুই লেন থেকে ছয় লেন সড়ক নির্মাণ করতে বাকি গাছগুলোও কেটে ফেলা হলো। পুরো ৮ কিলোমিটার সড়ক এখন গাছশূন্য। দুই দফা সংস্কারে এই সড়কে প্রায় হাজারের বেশি ছোট বড় গাছ কাটা পড়েছে। প্রকল্প শেষে সড়কের আইল্যান্ডে কিছু গাছ লাগানো হলেও তা ইতোমধ্যে মারা যেতে শুরু করেছে। যেগুলো রোপণ করা হয়েছে, তা কেবল সৌন্দর্য্য বর্ধনের গাছ। কিন্তু এখানে বড় বৃক্ষ জাতীয় গাছ প্রয়োজন- যা পাখি, পোকা-মাকড়, পতঙ্গের আবাস হিসেবে গড়ে উঠতে পারে,” বলেন তিনি।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ছয় লেনে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি ঢাকা মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের আদলে রূপ পেয়েছে। দ্রুতগতির যান চলাচলের জন্য চারটি লেন এবং কম গতি সম্পন্ন যানবাহনের জন্য দুইপাশে সার্ভিস লেন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মোড়ে দেওয়া হয়েছে ওভারপাস।
এই সড়কে দুই লেন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট তৈরি হতো। নতুন সড়ক নির্মিত হওয়ার পর সেই ভোগান্তি নেই বললেই চলে। মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিটে সাইনবোর্ড থেকে চাষাঢ়া চলে আসতে পারেন যাত্রীরা। তবে পূর্বের সেই সবুজে ঘেরা মনোরম পরিবেশ এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না।
পরিবেশবিদদের মতে, সড়ক নির্মাণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করলে সড়কের গাছগুলো দীর্ঘপ্রাণ পেত। সূত্র: টিবিএস
ক্যাটাগরিঃ রাজধানী
ট্যাগঃ
মন্তব্য করুন